
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান সিনিয়র জেনারেল অং মিন হ্লাইংসহ শীর্ষস্থানীয় ১০ জেনারেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসেছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী পরিচালিত অন্যতম তিন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান মিয়ানমার রুবি এন্টারপ্রাইজ, মিয়ানমার ইম্পেরিয়াল জেইড কো. লিমিটেড ও ক্যানকারি (জেমস অ্যান্ড জুয়েলারি) কো. লিমিটেড।
এদিকে মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়ে বেসামরিক সরকারের হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। দেশটির সরকারের জন্য এর আগে বরাদ্দ করা চার কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা) প্রত্যাহার করেছে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা—ইউএসএআইডি।
মিয়ানমারের প্রায় ৩০০ এমপি দেশটিতে সামরিক জান্তা ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে অভিযোগ করে জাতিসংঘের প্রতি বিষয়টি তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের কাছে পাঠানো চিঠিতে এমপিরা বলেছেন, সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতিবাদকারীদের উদ্দেশে গুলি ছুড়ছে সামরিক বাহিনী।
মিয়ানমারে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অং সান সু চির সরকারকে উত্খাত করে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় দেশটির ১০ জেনারেলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিল যুক্তরাষ্ট্র। গত বৃহস্পতিবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ও অর্থ দপ্তর মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে সরাসরি জড়িত এই ১০ জেনারেলকে চিহ্নিত করে তাঁদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের আদেশ জারি করে। এর আগের দিন বুধবার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এসংক্রান্ত এক নির্বাহী আদেশে সই করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেছেন, মিয়ানমারের যে ১০ জন জেনারেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে তাঁদের মধ্যে ছয়জন গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে উত্খাতে সরাসরি জড়িত। অন্য চারজন সাবেক জেনারেল। তাঁরা মিয়ানমারের সামরিক নতুন প্রশাসনে বিভিন্ন দায়িত্বে আছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেনারেল অং মিন হ্লাইংকে তাঁর অধীন বাহিনীর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। এবারের নিষেধাজ্ঞার তালিকায়ও তাঁর নাম শীর্ষে আছে। এ ছাড়া প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল মিয়া তুন ও, যোগাযোগ ও পরিবহন মন্ত্রী অ্যাডমিরাল টিন অং সান, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাউন্সিলের জয়েন্ট সেক্রেটারি লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়ে উইন ও এবং সেক্রেটারি লেফটেন্যান্ট জেনারেল অং লিন দুয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর বাইরে দেশটির ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল মিন্ট সুয়ে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল সেইন উইন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল সুয়ে হাট ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়ে অং—এই চারজন অভ্যুত্থান-পরবর্তী জান্তা প্রশাসনের বিভিন্ন দায়িত্বে আছেন। তাঁদের ওপরও যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
এই নিষেধাজ্ঞার ফলে যুক্তরাষ্ট্রে তাঁদের নামে-বেনামে থাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত হবে। ওই ১০ জেনারেল ও তিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কেউ ব্যবসা বা অর্থনৈতিক লেনদেন করতে পারবে না। অন্য দেশগুলোও যাতে মিয়ানমারের ক্ষেত্রে অনুরূপ ব্যবস্থা নেয় সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র তার বৈশ্বিক মিত্র ও অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে প্রস্তাব গৃহীত : গতকাল শুক্রবার বিকেলে জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মিয়ানমারে নির্বাচিত সরকারকে উত্খাত করার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বেশির ভাগ সদস্য, পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র ও বেসরকারি সংস্থা। ওই অধিবেশনে মিয়ানমারের বেসামরিক সরকারের হাতে অনতিবিলম্বে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব ভোটাভুটি ছাড়াই গৃহীত হয়েছে।
তবে চীন এর বিরোধিতা করে জানায়, মিয়ানমারে যা ঘটছে তা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আর মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত তাঁর দেশের বাস্তবতা বুঝতে সবার প্রতি আহ্বান জানান। তবে এরপর মিয়ানমারের অধিকারকর্মীরা এই রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য দেওয়ার সময়ের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে বলেছেন, ওই ব্যক্তি মিয়ানমারের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন না।
মিয়ানমারবিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার টমাস অ্যান্ড্রুজ মানবাধিকার পরিষদে মিয়ানমার পরিস্থিতি তুলে ধরে দেশটির ওপর অস্ত্র, ভ্রমণ ও অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানান। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের ওই দূতকে মিয়ানমারে ঢুকতে দিচ্ছে না জান্তা সরকার।
মানবাধিকার পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবে মিয়ানমারে জরুরি অবস্থা জারি এবং স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ রাজনীতিবিদ, কর্মকর্তা, গণমাধ্যমকর্মীসহ অন্যদের গ্রেপ্তারের নিন্দা জানানো হয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলমানসহ সংখ্যালঘু অন্য গোষ্ঠীগুলোর ওপর নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে নিপীড়নকারীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
গৃহীত প্রস্তাবে সু চিসহ অন্য বন্দিদের অনতিবিলম্বে মুক্তি দেওয়াসহ জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা, বিশেষ দূতদের মিয়ানমারে ঢোকার সুযোগ দেওয়ার জোরালো তাগিদ রয়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও সম্মানজনকভাবে ফেরার অনুুকূল পরিবেশ সৃষ্টি এবং তাদের বাস্তুচ্যুতির মূল কারণগুলো সমাধান করতে বলা হয়েছে। গৃহীত প্রস্তাবে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তা মানবাধিকার পরিষদে তুলে ধরতে মিয়ানমারবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূতের প্রতিও আহ্বান জানানো হয়েছে।
ইউএসএআইডির তহবিল বাতিল : এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা—ইউএসএআইডির বরাত দিয়ে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস গতকাল শুক্রবার জানায়, মিয়ানমার সরকারের জন্য এর আগে বরাদ্দ করা চার কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় সাড়ে তিন শ কোটি টাকা) প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ইউএসএআইডির ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক গ্লোরিয়া স্টিল বৃহস্পতিবার রাতে ওয়াশিংটন ডিসিতে এ ঘোষণা দেন।
বিক্ষোভ অব্যাহত : সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ‘হাত মেলানোর’ আহ্বান উপেক্ষা করে গতকালও মিয়ানমারের রাজপথে নামে বিক্ষোভকারীরা। ইউনিয়ন ডে উপলক্ষে জান্তা সরকারের প্রধান জেলারেল মিন অং হ্লাইং এদিন ‘ঐক্যে’র ডাক দিয়ে বিক্ষোভ, গণজমায়েত বন্ধের আহ্বান জানান।
তবে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে সংকল্পবদ্ধ হয়ে টানা সপ্তম দিনের মতো গতকাল মিয়ানমারজুড়ে বিক্ষোভ করে গণতন্ত্রপন্থীরা।
মিয়ানমারে কর্মরত একজন রেডক্রস কর্মকর্তা জানান, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় মাওলামাইন শহরে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়লে তিনজন আহত হয়।
গত ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে উত্খাত করে মিয়ানমারে ক্ষমতার দখল নেয় সেনাবাহিনী। এরপর থেকেই জান্তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছে। এ অবস্থায় গতকাল সামরিক জান্তা নেতা জেনারেল মিন অং হ্লাইং প্রথম জনসম্মুখে এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বিক্ষোভের অবসান ঘটিয়ে সরকারি চাকরিজীবীদের অবিলম্বে কাজে ফেরার আহ্বান জানান।
এদিকে ইউনিয়ন ডে উপলক্ষে গতকাল ২৩ হাজার ৩১৪ জন কয়েদিকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। দেশটির জেলখানাগুলোতে ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি বন্দি রয়েছে। প্রতিবছর নানা জাতীয় দিবসে কিছু কয়েদিকে মুক্তি দেওয়া হয়।
পাঠকের মতামত